কক্সবংলা ডটকম :: চলমান ডলার সংকটে অবমূল্যায়ন হচ্ছে টাকার। গত দেড় বছরে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এর প্রভাব পড়ছে সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে। সরকারের তথ্য বলছে, টাকার হিসাবে গত এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। পাশাপাশি সুদ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে ব্যাপকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটছে, যা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দেশের চাপ সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করা হলেও নীতিনির্ধারকরা তাতে পাত্তা দেয়নি। এখন ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানোর জন্য আমদানি সংকোচন করতে হচ্ছে। এর প্রভাবে সার্বিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে।
ইআরডির জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদের বৈদেশিক ঋণের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ঋণ ও সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। পরিমাণে বেড়েছে ৭ হাজার ৯৮২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২০ হাজার ৪১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ হাজার ৪৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এ সময়ের মধ্যে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৩৬৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরে ঋণের আসল পরিশোধ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বৈদেশিক অর্থছাড় হয়েছে ৪৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। যেখানে একই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এসেছিল ৪০৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সেই হিসাবে শুধু জানুয়ারি মাসে দাতা সংস্থাগুলো অর্থছাড় করেছে ৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
বেড়েছে ঋণ প্রতিশ্রুতিও : ইআরডির তথ্য মতে, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দাতা সংস্থা ৭১৭ কোটি ২১ লাখ ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল মাত্র ১৭৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। অর্থাৎ অর্থবছরের ব্যবধানে প্রতিশ্রুতির পরিমাণ বেড়েছে ৫৪০ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে। সংস্থাটি ২৬২ কোটি ২ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ২০২ কোটি ৬ লাখ ডলারের। বিশ^ব্যাংক দিয়েছে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি। তবে অর্থছাড় করলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি।
প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি অর্থছাড়েও এগিয়ে এডিবি। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১২৪ কোটি ১১ লাখ ডলার অর্থছাড় করেছে সংস্থাটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থছাড় করেছে জাপান। দেশটির উন্নয়ন সংস্থা থেকে অর্থ এসেছে ৮৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) কাছ থেকে অর্থ এসেছে ৭৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
এ সময় ৫৮ কোটি ৭৭ লাখ ডলার দিয়েছে রাশিয়া, ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার দিয়েছে চীন। এ ছাড়া ভারত ১৬ কোটি ৯৬ লাখ এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এসেছে। বাকি ৩৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার অর্থছাড় করেছে অন্যান্য দাতা সংস্থা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে-এটি আমরা ২০২২ সাল থেকেই বলে আসছি। ২০২৪ সালের পর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে সেটিও বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সে বক্তব্যকে সরকারের নীতিপ্রণেতারা তখন গুরুত্ব দেননি।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখন সমস্যা হচ্ছে এবং ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানোর জন্য আমদানি সংকোচন করতে হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা পুনর্মূল্যায়ন করে ঋণের সীমা নির্ধারণ করা উচিত। তা না হলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর প্রতি বছর তা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর আবার টাকার কিছুটা অতি মূল্যায়নও হয়েছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছর সর্বোচ্চ ১১ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছিল ডলার। এরপর বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছর সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকার।
স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের পর এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন। ওই অর্থবছর ডলারের বিপরীতে টাকা ৬৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল। ওই অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়ন হয় ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
Posted ৪:৪৩ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৬ মার্চ ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta